সংস্কৃত শব্দ যৌন। যার অর্থ- যোনি সম্পর্কিত বা সম্বন্ধযুক্ত । হয়রানি ফারসি শব্দ । যার অর্থ- নাকালের একশেষ বা হয়রান হওয়ার ভাব, বিব্রতকর অবস্থা। দুটো মিলে অর্থ দাঁড়ায় যৌনি সম্পর্কিত পরিশ্রান্ত বা জব্দ হওয়া/ করা।
যৌন হয়রানি হলো যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণ, যৌনতার সুযোগের চেষ্টা/অনুরোধ, যৌন আবেদনমূলক মৌখিক বা শারীরিক আচরণ, যৌন-প্রকৃতির অন্য কোনো প্রকারের আচরণ যা যুক্তিসঙ্গতভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, অপমান বা হয়রানিরূপে গণ্য হয়। যৌন হয়রানির সাথে শিক্ষক শব্দটা বেশ বেমানান বটে।
রৌমারীতে শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির স্বীকার ব্যাপ্তিযুক্ত উৎকণ্ঠা/দুশ্চিন্তায় মুড়িয়ে গেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সুধীমহল। গেলো দুই দিন আগে বেহুলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর উপর যৌন হয়রানির অভিযোগ কোনো ক্রমেই কারোই কাম্য নয়।
ধর্ষণ এক ধরনের যৌন নিপীড়ন। ধর্ষণ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে কখনো কখনো যৌন আক্রমণ বা বলৎকার শব্দ ব্যবহৃত হয়। একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন- কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি) এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় যৌন হয়রানি ধষর্ণের পূর্ব প্রস্তুতি। কিন্তু একজন শিক্ষকের বেলায় এমন শব্দ প্রয়োগ করতে নিজেরই অস্বস্তিবোধ করছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে কর্তব্যকর্মের বিষয়ে চিন্তা বা সংকল্প-ই শিক্ষাব্রত। শিক্ষা শব্দটি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত। একপক্ষে শিক্ষক আরেকপক্ষে শিক্ষার্থী। সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে উৎপত্তি শিক্ষা শব্দের অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। ‘বিদ্যা’ শিক্ষা শব্দের সমার্থক শব্দ । সংস্কৃত ধাতু ‘বিদ ’থেকে বিদ্যা; যার অর্থ ‘জানা’ বা ‘জ্ঞান’ অর্জন করা ।
লাতিন শব্দ ‘অ্যাডুকেয়ার’ বা ‘অ্যাডুকাতুম’ থেকে উৎপত্তি ‘অ্যাডুকেশন’ যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। সহজ কথায় শিক্ষার্থীর আচরণের অভিলষিত ইতিবাচক অবস্থান্তর বা বদলানোই শিক্ষা। শিক্ষা মানব জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ ও রত্নাভরণ শিরোভূষণ। প্রায় চারশো বছরের পুরনো ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনও বলেছিলেন-“শিক্ষাই সব শক্তির মূল । আর ওই শিক্ষা গ্রহণকালে যদি শিক্ষার্থী নিরাপত্তা না পায় তবে শিক্ষার আলোর অর্থ হয় অন্ধকার।
প্রধান শিক্ষক আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর উপর যৌন হয়রানি খবরটা যেভাবে পাই। ওইদিন বিকেল ৫টার প্রেসক্লাব থেকে বের হয়েছিলাম চায়ে চুমুক দিতে। চায়ের কাপে মুখ দিলেও দৃষ্টি সংবরণ করতে পারছিলাম না চায়ের কাপে ও টেবিলে। পাশে দেখি প্রাইমারি স্কুলের ড্রেস পরিহিত কিছু শিক্ষার্থী ও কয়েকজন শিক্ষক নৈরাশ্যের চিত্রপট ভাসিয়ে তুলছে। নানা অনুসন্ধিৎসায় এক সহকারী শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম কাণ্ড কী? এর মধ্যে পাশে থাকা এক আলাপি লোক বলল- ওনাকে সব খুলে বলেন ওনি সাংবাদিক।
বিস্তারিত শোনা পর নিজেকে আর নিজের আয়ত্তের রাখলাম না। ছুটে পড়লাম খবরের পেছনে। ঘটনা সত্য । ওই অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরেুদ্ধে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটার বিষয় নতুন নয়। এর আগেও তিনি প্রায় তিন তিনবার এমন নেক্কার ঘটার জন্ম দিয়েছেন। তার লেবাজ দেখলে মনে হয় সেও ধর্ম ব্যবসায়ী।
অতঃপর মনে পড়তে লাগল- সেই রৌমারীর এক মাদরাসার ৯ বছরের তৃতীয় এক শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ৫০ বছরের সাদেকুল ইসলাম সাদেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রান্নার জন্য মাঠ থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিল সাদেকের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে শিশুটিকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে সাদেক। উত্তর চাক্তাবাড়িতে ৪০ বছরের নুরুলসহ ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ৬ জন মিলে ধর্ষণের খবর। অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীকে শিক্ষার্থীকে কৌশলে ডেকে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। বেগম মজিদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোতাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের করে দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে । যাদুরচর ইউনিয়নের ধনারচর টাংড়াপাড়া গ্রামে বিয়ের প্রলোভনে তরুণীকে বিয়ের কথা বলে তরুণীকে বাড়ি থেকে ডেকে কাটিয়ামারী চরের নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ । আরও অনেক লেখা বাকি থাকল সময়ের অভাবে।
গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধষর্ণের সাজা দেখলে মনে হয় আইন আছে আইনে প্রয়োগ নাই। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সৌদি আরবে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হলে শিরোচ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, ইরানে ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলানো এবং কখনও কখনও পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড,
চীনে ধর্ষণের অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মেডিক্যাল পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কোনো দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড বা আজীবনের জন্য নপুংসক (castration) করে দেওয়া,
আফগানিস্তানে ধর্ষণের অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করা, উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় । গড়কথায় বলা যায় প্রায় প্রতিদেশেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযত আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নাই।
বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি, ২০২৩ সালে ১৪২টি।
দেশের আইনেও বলা আছে- যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
খোলস করে বললে- যদি কোন ব্যক্তি বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন শিশুর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনকর্ম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।
বেহুলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল আলম দ্বারা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি স্বীকারের ঘটনায় রৌমারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান পাইকাড়কে প্রধান , উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মঈনুল ইসলামকে সদস্য সচিব ও উপজেলা মৎস কর্মকর্তা উম্মে হোসনেআরা সহ তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রৌমারীবাসী অপেক্ষায় আছে এরকম নেক্কারজনক ঘটনার সঠিক বিচার হোক। আর কোনো শিক্ষক যেনো গোটা শিক্ষক সমাজের গায়ে কলঙ্কের দাগ লেপ্টে না দেয়, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
Leave a Reply