মোঃ পারভেজ আহমেদ:::: দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ফ্যাসিস্ট তৎপরতা কঠোর হাতে দমনে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ সিলেট বিভাগে ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ নিয়েছে। অভিযান শুরুর পর থেকেই সিলেট মহানগরসহ বিভাগের চার জেলা—সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে (যদিও সেখানে এখনো গ্রেফতার হয়নি)—নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
১৩ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে রাতভিত্তিক টহল, হঠাৎ হঠাৎ অভিযান, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসানো এবং গোয়েন্দা নজরদারি কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। নগর ও গ্রাম—সবখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি চোখে পড়ছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো জেলা বা উপজেলা থেকে গ্রেফতারের খবর আসছে, যা নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
পুলিশ জানায়, অভিযানের প্রথম ৯ দিনে (২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সিলেট বিভাগে মোট ৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা ও অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়ে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতারের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে মৌলভীবাজার জেলা, যেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় অভিযানও বেশি জোরদার করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী,
সিলেট মহানগর এলাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৭ জন,
সিলেট জেলায় ১৮ জন,
মৌলভীবাজারে সর্বাধিক ৩৫ জন,
সুনামগঞ্জে ৮ জন।
হবিগঞ্জ জেলায় এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেফতারের তথ্য না মিললেও সেখানে নজরদারি ও প্রস্তুতি অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
অভিযান চলাকালে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা—গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, জকিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী, দিরাই, ছাতকসহ প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। এসব এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও শ্রমিক লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারদের তালিকায় রয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর ও উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, ছাত্র ও যুব সংগঠনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় পরিচিত মুখ। এতে করে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও এত ব্যাপক অভিযান পরিচালিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অপরাধী নেটওয়ার্ক ভাঙা ও ভবিষ্যৎ সহিংসতা প্রতিরোধই অভিযানের মূল লক্ষ্য।
এদিকে অভিযানের মধ্যেই সিলেট নগরীর নাজিরেরগাঁও এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা ফয়েজকে আটক করে পরে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় মহলে গুঞ্জন ওঠে, স্বজনদের হস্তক্ষেপেই তিনি ছাড়া পান। তবে পুলিশ এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বলেছে, প্রাথমিক যাচাই শেষে আইনগত কারণেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৩ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালুর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান আরও কঠোর করা হবে এবং ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের জন্য বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান ও জমাকৃত অস্ত্র ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।
সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা ও সহকারী পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. সম্রাট তালুকদার বলেন,“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেট জেলা পুলিশ নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। গোপন তথ্য ও গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা এবং সাধারণ মানুষের জানমাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন,“মহানগর এলাকায় নিয়মিত টহল, চেকপোস্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান জোরদার করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও মামলা রয়েছে, শুধু তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছি।
তিনি আরও জানান, নগরবাসীর নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply