মো.পারভেজ আহমদ :::: লিবিয়ায় চার বছর ধরে মাফিয়াদের হাতে বন্দী ছিলেন সিলেটের লন্ডনী রোডের জাহাঙ্গীর আলম। একের পর এক ক্যাম্পে ঘুরিয়ে নির্যাতন চালাতো মানবপাচারকারীরা। তারা মাফিয়াদের কাছে বাংলাদেশিদের বিক্রি করে দিতো। ক্যাম্প বদলের পরপরই বাড়তো টাকার জন্য চাপ দেওয়া। অন্যথায় উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানোর দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। নির্যাতন থেকে বাঁচতে চার বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে তার পরিবারকে।
ইউরোপ যাওয়ার জন্য নেপালে গিয়ে মাফিয়াদের হাতে বন্দী হওয়া দক্ষিণ সুরমার এম এ মান্নান জানান, পিস্তল ধরে পরিবারের সাথে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা টাকার জন্য ক্যাম্পে আটকে রাখাসহ বেধড়ক পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রাখার দিনগুলো ছিলো শিউরে ওঠার মতো।
শুরু জাহাঙ্গীর কিংবা মান্নান নয়, ইউরোপের নেশায় বুঁদ হওয়া সিলেটের শত শত তরুণ যুবক লিবিয়া, নেপাল, কেনিয়ায় এখনো বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন মাফিয়াদের কাছে। এদের মধ্যে ভাগ্যবান গুটি কয়েক তরুণ, যুবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগর পেরিয়ে স্বপ্নের দেশে প্রবেশ করতে পারলেও বেশিরভাগেরই মরতে মরতে বেঁচে ফিরছেন। অনেকে আবার মাফিয়াদের নির্যাতনে বন্দী অবস্থায় জীবন হারাচ্ছেন, তাদের লাশটাও শেষবারের মতো দেখতে পান না স্বজনরা।
লিবিয়া ফেরত জাহাঙ্গীর আলমের ভাই ফেরদৌস আহমদ বলেন, মাফিয়াদের হাতে বন্দী জাহাঙ্গীরকে নির্যাতনের ভিডিও দেখে তার মা স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে মারা যান। ভাইকে বাঁচাতে সহায় সম্পত্তি, সোনাদানা সবই বিক্রি করে তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েও মাফিয়াদের দাবি পরিশোধ করতে হয়েছে ভাইকে বাঁচাতে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্সের পর্যটন সাব কমিটির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির লিটন জানান, সিলেটের এক শ্রেণির ট্রাভেল ব্যবসায়ী লোভনীয় ফাঁদ পেতে যুবকদের আকৃষ্ট করছে। তারা নেপাল, কেনিয়া কিংবা লিবিয়া হয়ে ইউরোপের দেশে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এ কারণে অনেক দেশ বাংলাদেশকে পর্যটন ভিসা দিচ্ছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন খান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, লোভনীয় অফারে নিঃস্ব হচ্ছে পরিবারগুলো। স্বামী, সন্তান হারিয়ে পথে বসছেন অনেকে। মাফিয়াদের হাতে জিম্মি হওয়াদের ছাড়াতে বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে হচ্ছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
প্রবাসী অধ্যূষিত সিলেট অঞ্চলে মানবপাচার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর যুবকরা লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বছরের পর বছর বন্দী থেকে হয়েছেন নির্যাতিত। লাখ লাখ টাকা মাফিয়াদের দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পরিবারগুলো। শুধু গত ৬ মাসেই সিলেটে মানবপাচার আইনে দায়ের হয়েছে ১৯টি মামলা।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রলোভনে পড়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন তরুণ, যুবকরা। বিভিন্ন দেশে ‘গেম ঘর’ নামে ছোট্ট কুটুরিতে তাদের আটকে নির্যাতন করার বিষয়টি আমরা তদন্তকালে জেনেছি। অনেকেই মানবপাচারকারীদের মুক্তিপন মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। সিলেটের মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় হওয়া ১৯টি মামলা ঢাকা সিআইডি তদন্ত করছে।
Leave a Reply