সবসময় ডেস্ক ::: সিলেট বিভাগে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ছনবাড়ী বাজার এলাকায় কৌশলগত অবস্থান নেয় সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি)। একপর্যায়ে সন্দেহজনক অস্ত্র চোরাকারবারিরা বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ছনবাড়ী বাজারের নিকটবর্তী বালুর স্তূপের নিচ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক, ২টি ডেটোনেটর ও ১টি বিদেশি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। গত শুক্রবার এমন তথ্য জানান সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্তবর্তী সিলেটের ওপর দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসার শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। সেই শঙ্কার ভয়াবহ বাস্তবতাই যেন দেখা গেল ৪৮ বিজিবির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক, ডেটোনেটর ও বিদেশি রিভলবার উদ্ধারের ঘটনায়।
বিভাগের চারটি জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের সঙ্গে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকা। সে কারণে সিলেট বিভাগ অবৈধ চোরাচালানের হটস্পট হিসেবেও পরিচিত। সিলেট সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ রোধ করতে না পারলে আসন্ন নির্বাচন সংঘাতপূর্ণ ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) দেওয়া বিদেশি অস্ত্র এবং বিস্ফোরক উদ্ধারের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিলেটের সীমান্ত এলাকা থেকে ৫টি এয়ারগান, ২টি বিদেশি রিভলবার, ৬ রাউন্ড গুলি, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক এবং ২টি ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ এপ্রিল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মিনাটিলা এলাকা থেকে ১টি এয়ারগান, ২৪ আগস্ট গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী জাফলং চা-বাগান সংলগ্ন এলাকার কাটারী নামক স্থান থেকে ৪টি এয়ারগান, ২৮ আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী মাওলারপাড় ব্রিজসংলগ্ন এলাকা থেকে ১টি বিদেশি রিভলবার ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ৩১ অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী ছনবাড়ী বাজার এলাকা থেকে ১টি বিদেশি রিভলবার, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক এবং ২টি ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়। এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বিজিবি। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। গত ১২ অক্টোবর জকিগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (১৯ বিজিবি) গুয়াবাড়ি বিওপির একটি বিশেষ টহল দল জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় দরবস্তের ভাইটগ্রাম নামক স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ভারতীয় এয়ারগান, চারটি রামদা ও দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়
।
এই পরিস্থিতিতে সিলেট সীমান্ত দিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা উদ্বেগজনক মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির ওপর বিশেষ গুরুত্ত্বারোপ করছেন তারা।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), সিলেটের সভাপতি সৈয়দা শিরীন আক্তার বলেন, ‘যেহেতু নির্বাচন আসন্ন, তাই সীমান্ত দিয়ে এসব উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। অবশ্যই সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর ব্যবহার হতে পারে। সামনে যারা ক্ষমতায় যেতে চান তারা অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। যেকোনো পক্ষই অরাজকতা করতে পারে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক দিয়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক জমা করা হচ্ছে। পরে যখন নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হবে তখন এসবের ব্যবহার হবে।’
এসব অস্ত্র চোরাচালান বন্ধে বিজিবির টহল বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অবস্থানে যাওয়া দরকার। পুলিশি টহল আরও বাড়ানো দরকার। প্রশাসনের এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতে হবে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর থানাগুলোকে অতিরিক্ত পুলিশ নজরদারিতে রাখতে হবে। তালিকা ধরে অস্ত্র চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। ’
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সিলেট জেলার যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য একটি গোষ্ঠী বরাবরই এসব করে। ভোটার এবং সাধারণ জনগণকে ভয়ভীতি দেখানোই তাদের উদ্দেশ্য। এ ধরনের কার্যকলাপ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই নির্বাচনের জন্য সীমান্ত দিয়ে বিস্ফোরক ও অস্ত্র আসা হুমকিস্বরূপ। এসব শক্তিশালী বিস্ফোরক কোনো নির্বাচনি জনসভায় ফাটানো হলে ভয়াবহ প্রাণহানি হতে পারে।’
নির্বাচনি মাঠে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য এসব বিস্ফোরক ও অস্ত্র দেশে আনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবসময় দেখি সীমান্তে অবৈধ জিনিস জব্দ হয়, অস্ত্র উদ্ধার হয়, কিন্তু কাউকে আটক করা হয় না। বৃহস্পতিবার তো বিজিবি চোরাকারবারিদের ফেলে যাওয়া কিছু বিস্ফোরক ও অস্ত্র কুড়িয়ে আনল। তার মানে প্রতিনিয়তই সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসছে। এটা অবশ্যই দেশের জন্য অশুভ বার্তা। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত। সীমান্তরক্ষীদের আরও শক্তিশালী করা দরকার। তাদের সক্ষমতাও বাড়ানো উচিত।’
জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সুজন সিলেটের সহসভাপতি তাহমিনা ইসলাম বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। আমরা সামনে একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করছি। এই নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষ মুখিয়ে আছেন। আমাদের দেশ পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনটি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ। নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো সন্ত্রাসী কাজ দেশের শান্তির পথকে হুমকিতে ফেলবে। আমরা যখন একটি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছি তখন সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র বা বিস্ফোরক আসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে আরও নজর দেওয়া উচিত। এসব অস্ত্রের উৎস, কারা জড়িত সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে এবং কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।’
Leave a Reply