নিজস্ব প্রতিবেদক :: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে বাংকার এলাকায় চলছে প্রকাশ্যে পাথর লুট। ধলাই নদীবেষ্টিত এই এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়ে গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলন করছে। ৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার পাথর চুরি হচ্ছে বারকী নৌকা দিয়ে। ফলে বাংকার এলাকার অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতকে রজ্জুপথ স্থাপন করা হয়। ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে তৈরি হয় রোপলাইন। এর মধ্যে আছে ভোলাগঞ্জ লোডিং স্টেশন বাংকার ও ছাতক খালাস স্টেশন। বাংকারের ৩৫৯ একর জমি, অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি দেখভাল করতে ২০১২ সালে দায়িত্ব নেয় রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আরএনবি সদস্যদের ওপর দুর্বৃত্তরা করে মোবাইল, অর্থ ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ৭ আগস্ট বাংকার এলাকা থেকে আরএনবি সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা রোপওয়ের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল লুটপাট ও চুরি করে পাথর লুট করছে। গভীর গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের কারণে বাংকার এলাকা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ছাতক পর্যন্ত যাওয়া রোপওয়ের পিলারগুলো হেলে পড়েছে। বাংকার এলাকার ভবনগুলোর নিচ থেকে মাটিখুঁড়ে পাথর তোলায় মাটি সরে যাওয়ায় অনেক স্থাপনা ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে এবং বাকিগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। পাথর লুটকারীরা দাবি করছেন, তারা সনাতন পদ্ধতিতে পাথর তুলছেন, তাই ক্ষতি হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংকার এলাকা ঘিরে চলছে পাথর লুটের উৎসব। বাংকারের চারিদিকে দল বেঁধে ছোচ ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পাথর তুলছেন স্থানীয়রা। ২৬/৩০ ফুট গভীর গর্ত করে ৩/৪ জন মাটি খুড়ে পাথর তুলছে। কেউবা ছোট ছোট নুড়ি পাথর চালনি দিয়ে আলাদা করছে। কেউ বা উত্তোলিত পাথর নদীর পারে স্তুপ করছেন, যাতে বারকী নৌকা ঘাটে ভিড়ে সহজে তুলে নিতে পারে। নারী পুরুষ একাকার হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন। পাথর উত্তোলনের ফলে গোটা বাংকার এলাকায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রেলওয়ের রোপওয়ের সংরক্ষিত বাংকারের ঠিক পেছনে বিস্তৃত এলাকায় পাথরের স্তূপ জমা ছিল। সেখানটি এখন প্রায় শূন্য। দুষ্কৃতকারীরা সংরক্ষিত এলাকার আবাসন কক্ষ ও স্টোর রুমের তালা ভেঙে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংকারের মসজিদের মাইক, ব্যাটারি, ফ্যানসহ সব ধরনের মালামাল লুটপাট হয়ে গেছে। লুটপাট এখনো চলমান রয়েছে।
পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িতদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার দিন কাটাচ্ছেন। অরক্ষিত বাংকারের কারণে তারা সনাতন পদ্ধতিতে অর্থাৎ বেলচা, কোদাল ব্যবহার করে পাথর তুলছেন। জীবনের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে পাথর তুলতে হচ্ছে তাদের। পুরো কোয়ারি খুলে দেওয়া হলে বাংকার থেকে কোয়ারিতে নামবেন তারা।
বাংকার এলাকায় পাথর উত্তোলনকারী উত্তর রাজনগরের আক্তার হোসেন বলেন, আমরা পেটের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে পাথর তুলছি। পাথর কোয়ারি খোলা থাকলেও তো বাংকারে হাত দিতাম না। আপনারা (গণমাধ্যমকর্মী) আমাদের জন্য লিখুন, যাতে সরকারের টনক নড়ে। হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের কথা চিন্তা করে সরকার সনাতন পদ্ধতিতে পাথর তোলার অনুমতি দিলে সকলের বেকারত্ব কাটবে।
কালিবাড়ির আবদুল হামিদ বলেন, আমরা পেটভূখা মানুষ। জীবন বাঁচাতে পাথর তুলছি। আমরা জানি গভীর গর্ত করে পাথর তোলা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছুটা পাথর তুলি আবার মাটি ফেলি, যাতে গর্ত ধ্বসে না পড়ে।
লাছুখাল গ্রাম থেকে আসা মো, নহর মিয়া বলেন, আমরা দু’দিন ধরে পাথর তুলছি। আমাদের গ্রুপে কয়েকজন রয়েছে। কেউ গর্ত থেকে পাথর তুলে দিচ্ছি, কেউ চালনি দিয়ে ছোট পাথর আলাদা করছে। আবার কেউ নদীরপারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রির জন্য।
সিলেটের রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর চৌকির চীফ ইন্সপেক্টর এনায়েত করিম বলেন, ৭ আগস্ট নিরাপত্তার স্বার্থে রেলওয়ের কর্মীদের প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এখনো রেলওয়ের কেউ এখানকার দায়িত্বে যাননি। তাই বর্তমানে এই জায়গাটি অরক্ষিত আছে। আমি ঘটনাস্থল দুবার পরিদর্শণ করেছি। বাঙ্কারে লুটপাট চলছে। এছাড়া বাঙ্কারে বসবাসের উপযোগি কাঠামো করার তাগিদ দিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছি।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, পুলিশ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, বেশ কিছু পাথর জব্দ ও মামলা করেছে। সামাল দিতে দ্রুত সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। পাথর লুটের কারণে ভোলাগঞ্জ রেলওয়ে বাংকার এলাকা বর্তমানে সংকটের মুখে। কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংকার এলাকার অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দুটোই ধ্বংসের মুখে পড়েছে। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পাথর লুট বন্ধ করা এবং বাংকার এলাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন তিনি।
Leave a Reply