অন্যায় কিংবা জুলুম, করিনি কোনো অপরাধ, তারপরও আমি বিগত ফ্যসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে পুলিশের খাতায় ছিলাম মিথ্যা আর সাজানো অস্ত্র মামলার আসামী। আমার উপর চলা নির্মমতার আজ এক বছর অতিবাহিত হচ্ছে। এখনও শরীরে থাকা হাসিনার পুলিশ লীগের নির্যাতনের স্টিমরোলারের আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। তারপরেও দুঃখ নেই। কারণ হাজার হাজার ছাত্র জনতার হত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার দোসররা আজ পলাতক। তাদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে বাংলার কোটি কোটি মানুষ।
ফিরে দেখা ২০২৪ সাল
২৪ এর ১৮ই জুলাই সিলেট নগরীর প্রবেশ পথ হুমায়ুন রশিদ চত্বরে ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শাটডাউন কর্মসূচি পালনকালে হঠাৎ করেই পুলিশ অতর্কিতভাবে টিয়ারশেল গুলি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চেষ্টা করে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করার। কিন্তু সকল ছাত্র-জনতা এর তুমুল প্রতিবাদ গড়ে তুলে, পুলিশের গুলির বিপরীতে ছাত্র জনতা পাটকেল দিয়ে প্রতিরোধ করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুলিশ বাহিনীদের,
১৮ই জুলাই যখন কর্মসূচি শেষ করে বাড়িতে যাই, তখন হঠাৎ করে এই খবর পাই যে মামলা দায়ের হচ্ছে, মামলা দায়ের তো হবে কারণ সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে মামলা হওয়ারই কথা, জানার চেষ্টা করলাম কি মামলা তখন জানা যায় মামলাটি দায়ের হচ্ছে যে পুলিশের অস্ত্র নাকি ছাত্র-জনতা নিয়ে গেছে, মানে পুলিশের পিস্তল নাকি ছাত্র-জনতা নিয়ে গেছে, এ কথা শুনে হাসতে থাকি এবং ভাবলাম একটা পাগল ও বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা যে, পুলিশের কাছ থেকে ছাত্ররা অস্ত্র নিয়ে গেছে, সেটাকে কেন্দ্র করে হচ্ছে মামলা, আমি আর এইসব এর গুরুত্ব দেইনি, কারণ হাসিনার গায়েবী মামলায় বিগত ১৭ বছর থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদী ভাইরা জর্জরিত নিপীড়িত নির্যাতিত,
১৯ জুলাই প্রতিদিনের মতো কর্মসূচি পালন করে বাসায় ফিরি আনুমানিক বিকেল ৫ টার দিকে, বাড়িতে এসে ভাত খেতে বসলাম খেতে থাকা অবস্থায় আমার মোবাইলে একটি ফোন আসলো আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন চাচা আমাকে জানালেন ফোন দিয়ে যে গতকালের পুলিশের সাথে যে সংঘর্ষ হয়েছিল পুলিশ মামলা দায়ের করেছে সেখান থেকে নাকি পুলিশের পিস্তল নাই হয়ে গেছে,
তখন আমি বিশ্বাস করলাম যে আসলেই হাসিনার দ্বারাই সব সম্ভব ছিলো, তো চাচা ফোনে জানালেন খুবই সাবধানে চলাফেরা করার জন্য বাড়িতে না থাকার জন্য, তখন আমি এই কথাগুলোর কোনো গুরুত্ব দেয়নি, ভাত খাওয়া শেষ করে আবার বেরিয়ে যাই,
যখন আমি আমার বাড়ির রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলতেছিলাম আমার ভাইদের সাথে, তখন হঠাৎ করে একজন লোক আমার পিছন দিক থেকে এসে আমাকে বলল,
এই তোমার নাম কি, তারপর তোমার বাবার নাম কি, ততক্ষণে তো আর আমার বুঝতে বাকি নাই ওরা কারা চোখ দিয়ে চারপাশ যখন দেখি ওরা সবাই আমাকে ঘিরে ফেলেছে সাদা পোশাক ধারী ডিবি পুলিশ,,,,
তখন রাস্তার আরেকপাশ থেকে ডিবি পুলিশ দৌড় দিয়েছে আমার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,
তখন নিজেকে একটু আত্মরক্ষার চেষ্টা করি পুলিশের হাত থেকে, ঠিক তখন সিএনজি দিয়ে আরেকজন ডিবি পুলিশ আমার পায়ে এসে লাথি দিয়ে আমাকে রাস্তার মধ্যে ফেলে দেয় তখন ওরা সবাই আমাকে ঝাঁপিয়ে ধরে, পড়ে গিয়ে আমার পায়ের হাতের মারাত্মক জখম হয়, তোমার হাত এবং পা দিয়ে ব্লেডিং হচ্ছে।
তারপর তোমাকে গাড়িতে তুলে, তুলে নিয়ে হুমায়ুন চত্বরে প্রায় ৪০ মিনিটের মত দাঁড়িয়েছিল তারা এটা চিন্তা করছে যে আমাকে নিয়ে যাবে কোথায় থানায় যাবে না ফাড়িতে যাবে না ডিবি কার্যালয় যাবে, তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় কদমতলী পুলিশ ফাড়িতে,
কদমতলী পুলিশ ফাঁড়িতে যখন নিয়ে যায় তখন সন্ধ্যা ৭ টা হয়ে গেছে, আমার যে হাতে পায়ে জখম হয়েছে তারা এগুলো উপলব্ধি করছে না,
আরেকটি কথা না বললেই নয় যখন আমি ফাড়িতে অনেক ক্লান্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছি, অনেক পানির পিপাসা হচ্ছিলো, দুঃখের বিষয় ঐদিন দায়িত্বে থাকা কদমতলী ফাড়ির আইসি দিবাংশু পাল আমাকে পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি, আরেকজন পুলিশ এসআই পানির বোতলটি এগিয়ে দিচ্ছিলেন তখন উনাকে উচ্চস্বরে না বলে দেন পানি দেয়া যাবে না, তখন আমার ভিতর থেকে একটি আওয়াজ আসছিল আল্লাহ তুমি আমাকে হেফাজত করো।
এবার ফাড়িতে আগমন ঘটলো, দক্ষিণ সুরমা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসি হাজির হলো, আমার সামনে ল্যাপটপ দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন সিসি ফুটেজ সেখানে আমি আছি এটাও দেখাচ্ছেন এখানে কাকে কাকে আমি চিনি নাম বলার জন্য, যখন বলি আমি জানিনা ওরা আমাদের এলাকার কেউ নয়।
তোমার হঠাৎ করে বলে ওঠে অস্ত্র কার কাছে অস্ত্র কোথায় অস্ত্র দিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না আমাদের ছেড়ে দিবে, আর বলে উঠলাম কিসের অস্ত্র এটা বলাতেই ওসি ইয়ারদুস সোহেল আমার কান বরাবর একটি চর বসিয়ে দিলেন, তারপর অস্ত্রের জন্য আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিতে থাকেন, আমি তো নিশ্চুপ আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না, কারণ আমি তো নিজেই জানিনা আমি তাদেরকে বলব টা কি, এরপর এস আই কামাল নাম করে আরেকজন পুলিশ আসলেন কোন কথা নাই বার্তা নাই এসেই আমাকে বলতেছেন উচ্চস্বরে,
এই শালা বল অস্ত্র কোথায় আর না হয় ক্রসফায়ার দিয়ে দিবো তিনি তার মোবাইলের ছবি দেখিয়ে বলতেছে এই দেখ আমি জঅই থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছি, এরপর ওনাকে আমি উত্তর দিয়েছিলাম,
আমার মউত যদি আপনার ক্রসফায়ারে লেখা থাকে তাহলে আপনার ক্রসফায়ার হবে আর না হয় আপনার ক্রসফায়ার আমাকে মারতে পারবে না আল্লাহ যদি সহায় থাকেন তারপরও গালিগালাজ করতে থাকে।
কতক্ষন পর রাত আনুমানিক ৯টা হবে থানার ওসি কি ইয়ারদুস সোহেল ও এস আই আনোয়ার, এসআই কামাল, ফাড়ির আইসি দিবাংশু পাল সহ আরো অনেক পুলিশ, আমার মোবাইল ফোন ওরা চেক করতেছে, মোবাইলের এমন কোন ডিভাইস নেই যে তারা চেক করে নাই, গ্যালারিতে থাকা অনেকগুলো ছবি যার সবই ছিল প্রায়ই রাজনৈতিক মিছিল মিটিং এর ছবি, তখন আমাকে বলে তুই কি মকসুদের সাথে রাজনীতি করস, কারন গ্যালারিতে ভাইয়ের সাথে অনেকগুলো পিকচার আর আমার মোবাইল ফোনের থাকা প্রোফাইল পিকচার ছিলো ভাইয়ের সাথে, তখন আমি বলি জি আমি মকসুদ ভাইয়ের সাথে রাজনীতি করি, তখন আমাকে বলে মকসুদ কই, মকসুদকে কই পাবো, আমার সাফ কথা আমি জানিনা।
তারপর ভাইয়ের কথা আর জিজ্ঞেস কিছু করি নাই,
এবার বলে আইসি দিবাংশু এই সাজাই কি হয় তোর বললাম আমার চাচা, দিবাংশু বলে সাজাই কই, আমার একই উত্তর জানিনা, তখন পাশে থাকা পুলিশ এসআই কামাল বলে ওসি কে বলে স্যার ওকে ভালো করে জিজ্ঞেস করেন সেই বলতে পারবে সাজাই কোথায়, এসআই কামালের কথায় ওসি ইয়ারদুস সোহেল আমার ফোন আমার কাছে দিলো, দিয়ে বলে যে সাজাই কে ফোন দে, তখন আমি জিজ্ঞেস করি ফোন দিয়ে কি করব কি বলবো, তখন আমাকে বলে ওসি ইয়ারদুস সোহেল যে আমার বিদেশের ভিসা হয়ে গেছে ইমার্জেন্সি ৫০ হাজার টাকা লাগবে টাকা না দিলে আমার ভিসা বাতিল হয়ে যাবে এখন আপনি যেভাবে পারেন আমাকে উদ্ধার করুন, এই কথা শিখিয়ে দিয়েছিল ওসি ইয়ারদুস সোহেল, যে সাজাই কে ফোন দিয়ে এইগুলো বলার জন্য,
তখন ফোন ধরিয়ে দেয় আমার কথা বলার স্টাইলে চাচার আর বুঝতে বাকি নাই যে আমি গ্রেফতার হয়ে গেছি আর এতক্ষনে চাচার কাছে খবরো চলে গিয়েছে যে আমি গ্রেফতার, তো জিজ্ঞেস করালো সাজাই চাচা কোথায়, আমি জিজ্ঞেস করলে চাচা উত্তর দিলেন যে তিনি রেঙ্গা হাজিগঞ্জ বাজারে এসে চাচাকে ফোন দিয়ে টাকা নেয়ার জন্য, তখন আর আমি বুঝতে পারি নাই যে আসলে কি চাচা আমার গ্রেফতারের খবর পেয়েছেন, যাই হোক সাজাই চাচা বললেন তিনি আছেন রেঙ্গা মাদ্রাসা আশেপাশে তখন আমাকে দিয়ে বলালো যে আমি গিয়ে চাচাকে ফোন দিবো,
আমি বললাম যাকে চাচা আমি এসে আপনাকে ফোন দিবো চাচা বললেন ঠিক আছে,
রাত আনুমানিক ১টা একদিকে আমার অবস্থা খারাপ প্রচুর পায়ে হাতে ব্যথা হচ্ছে ব্লেডিং হচ্ছে, অন্য দিকে তখন তারা দক্ষিণ সুরমা থানা থেকে ২০/২৫ জন পুলিশ নিয়ে রেঙ্গা হাজিগঞ্জ বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা, গেলাম চাচাকে গিয়ে ফোন দিলাম চাচা ফোন রিসিভ করলেন তখন আমি বলি চাচা কোথায় চাচা আমাকে অনেক সুন্দর একটি উত্তর দিয়েছিলেন তখন,
যে বাবা তোমাকে নিয়ে যারা আসছেন তাদেরকে বলো তাদেরও আল্লাহ বাচ্চার বাবা বানিয়েছেন, তাদেরকে বলো জুলুম না করতে আর তাদেরকে বলে দাও আমার জন্য কষ্ট না করতে ওরা চলে যেতে, তখনই আমার কান থেকে ফোন টান দিয়ে নিয়ে যায় দিবাংশু পাল,
ফোন নিয়ে বলে উঠলো, মাদার** বুঝে গেছে সবাইকে চলো থানায় চলে যাই, ওকে পড়ে দেখব।
তারপর ফেরার পথে রাত ২ টার দিকে আমাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তখন দায়িত্ব ডাক্তাররাও হতাশ হয়েছিলেন আমার হাতে পায়ের অবস্থা দেখে তারপর ওনারা ব্যান্ডেজ করে দিলেন নিয়ে আসলো থানায়,
২০ জুলাই কোর্টে চালান , কোর্ট থেকে কারাগারে, তারপর আবারও রিমান্ড শুনানি,
পুলিশের ১০ দিনের আবেদন ছিল রিমান্ডের জন্য কোর্ট ৪ দিনের মন্জুর করেন, তারপর তো আর নির্যাতনের শেষ নেই বাসায় প্রকাশ করার মতো না, আল্লাহতায়ালা যে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এটাই আমার জন্য অনেক বড় শুকরিয়া আল্লাহর কাছে, তারপর তো আর রিমান শেষে কারাগারের হাসপাতালে চিকিৎসাদিন ছিলাম কারাগারে প্রত্যেকটা দিন মনে হতো বছরের মত প্রত্যেকটি সেকেন্ড মনে হতো ঘণ্টার মতো, তারপরও মেনে নিতে হচ্ছে,
অবশেষে আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে ৫ ই আগস্ট হাজারেরও বেশি ছাত্র জনতার আত্মত্যাগ ও হাজার হাজার ছাত্রজনতা সহ পঙ্গুত্ব বহনকারী জনতা ও বাংলাদেশের আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভেসে যান ফ্যাসিস্ট হাসিনা, তিনি পালিয়ে যান ভারতে,
তারপর ৬ আগস্ট রাত ১ টার দিকে অর্থাৎ (৭ই আগস্ট) সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল ফটক থেকে অন্তবর্তী কালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাই আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ
মাহবুব আহমদ শাওন
যুগ্ম আহ্বায়ক ২৬ নং ওয়ার্ড ছাত্রদল,
সিলেট মহানগর
Leave a Reply