নাজিম আহমেদ, রৌমারী (কুড়িগ্রাম):
শিক্ষা জীবনের ভিত গড়ে ওঠে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে সেই প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজ করছে চরম বেহাল অবস্থা। যার কারণে উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার মান নিম্নমুখী। গত বছরের তুলনায় এ বছর শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ । প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ মিলে মোট শূন্যপদ রয়েছে ১০০টি ।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বৃদ্ধি করা হলেও সে তুলনায় উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেকটাই নিম্নমুখী এখনও। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতা ও উদাসীনতা, ব্যাচে প্রাইভেট পড়ানো, টিউশনিতে ব্যস্ত থাকা, সময়মতো স্কুলে আগমন-প্রস্থান না করা, স্থানীয় প্রভাব, অনেক প্রধান শিক্ষক স্কুলের কার্যক্রমের চেয়ে শিক্ষক সমিতির কাজে বেশি ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও দায়িত্বহীনতা সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করেন সুধীমহল।
খোদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও নিজের সন্তানদের ভর্তি করেছেন কিন্ডারগার্টেনে। গোটা উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার মান নিম্নমুখী হওয়ায় বেশিরভাগ বিত্তশালী ও সচেতন অভিভাবকের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করানোর প্রবণতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী সংকট দেখা য়ায়। অনেকে যত্রতত্র মাদ্রাসা গড়ে ওঠার কারণকেও দায়ী করেন।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, একটি শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ উপজেলায় মোট ১১৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য । এর মধ্যে নানা আইনী প্রক্রিয়া জটিলতার কারণে ১৮ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদের মামলা চলমান। ৩০টি বিদ্যালয় চলছে সহকারী শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের যাবতীয় শিক্ষাকার্যক্রম। সহকারী শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে ৭০টি।এতে নিম্নমুখী হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠদান ও গুণগমান।
গত বছর উপজেলায় মোট শিক্ষার্থী ছিলো ২০ হাজার ৮৩৯ জন। চলতি বছরে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৫৬৯জন। এক বছরে শিক্ষার্থী কমেছে ২ হাজার ২৭০জন। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ শুন্য থাকায় বিভিন্ন সচেতন ও অভিভাবক মহলে তুমুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ছে । অভিভাবকরা শঙ্কা করছে তাদের সন্তানের ভিত্তিগত শিক্ষাগ্রহণ নিয়ে।
অনেক প্রাথমিক স্কুল অনুমোদিত পদের চেয়ে কম সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। তার মধ্যে চর ইটালুকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ২জন ও পাহাড়তলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ২জন শিক্ষক দিয়ে চলছে। এ ব্যাপারে চরইটালুকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহাবুল আলম বলেন, ২০২৪ সালে প্রায় ১০মাস একাই স্কুল চালিয়েছি। চলতি বছরের মে মাসে মো. মইনুল ইসলাম সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১১৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীদে আমরা ২জন শিক্ষক আছি।
পাহাড়তলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মো. মোত্তালেব হোসেন বলেন- এই স্কুল বরাবরই সরকারের চোখে উপেক্ষিত। ২০২২ সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক ছিল ৩জন। ২০২৩ সালে ৪ জন। ২০২৪ সালে ২জন শিক্ষকের বদলি হলে এখন মাত্র ২জন শিক্ষক আছি। তার মধ্যে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। সহকারী শিক্ষিকা আতিয়া খাতুন সহ স্কুল সামলানো মুশকিল।
সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি, দায়িত্বে অবহেলা, অভিভাবকদের অসচেনতা ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঠিক তদারকি না থাকার কারণে উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষারমান নিম্নমুখী।
রৌমারী সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন- রৌমারীতে প্রাথমিক শিক্ষারমান অপ্রত্যাশিত অবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিম্নমুখী হওয়ার জন্য প্রধানত দক্ষ শিক্ষকের অভাব পাশাপাশি অভিভাবকরাও সমানতালে দায়ী। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান উদ্ধারে শিক্ষকের পাশাপাশি অভিভাবকদের সমানভাবে দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করতে হবে।
উপজেলার এক কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সেলিম মিয়া বলেন- আমার সন্তান প্রথমে সরকারি প্রাথকি বিদ্যালয়ে ছিল। কিন্তু সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ঠিকমতো লেখাপড়া হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় শিক্ষকরাই বুঝতে বা বোঝাতে পারেন না। অনেক সময় শ্রেণির মধ্যে যারা ভালো পড়েন, তাদের দিয়ে ক্লাসে করান। ছাত্রছাত্রী ঠিক মতো উপস্থিত না থাকা, টিফিনে বা অন্য যে কোনো সময়ে ইচ্ছামতো শিক্ষার্থীরা স্কুল ত্যাগ করলেও তেমন কোনো মাথাব্যথা থাকে না শিক্ষকদের। এককথায় সেখানে লেখাপড়ার মান খুবই খারাপ। যে কারণে বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের সরকারি স্কুল রেখে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করেছি।
এ বিষয়ে রৌমারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ মইনুল হোসেন বলেন- উপজেলার স্কুলগুলোর শুন্যপদ পূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা হবে। শিক্ষক সমিতির ব্যাপারে তিনি বলেন- শিক্ষকদের সমিতি নিয়ে গ্রুপিং আমাদের কাম্য নয়। আমি দুই গ্রুপের সাথে দফায় দফায় বসেছি। যাতে শিক্ষক সমিতির কারণে শিক্ষার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। সার্বিক শিক্ষারমান উন্নয়নে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
প্রসঙ্গত: চলতি বছরের মে মাসে রৌমারী প্রাথমিক শিক্ষক পরিবার-এর পক্ষ থেকে সংগঠনটির সভাপতি ও বোয়ালমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আহসান হাবিব সাদা স্বাক্ষরিত একটি চিঠি তার ফেজবুকে পোস্ট করেন। যেখানে ১০২ দুই শব্দের মধ্যে ২৪ টি শব্দের বানান ও প্রয়োগ ভুল পরিলক্ষিত হয়। আমার দেশ -এর রৌমারী উপজেলা প্রতিনিধি ওই চিঠির শুদ্ধীকরণ নিজের ফেজবুক ওয়ালে পোস্ট করেন। পরে ওই প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতির প্রতিনিধি ও সহকারী শিক্ষক আমার দেশ -এর রৌমারী উপজেলা প্রতিনিধির সাথে অপ্রীতিকর আচরণ করেন। তার অর্থ ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক পরিবারের সভাপতি ও সহকারী শিক্ষকগণ নিজেরাই বাংলা বানান ও শব্দের প্রয়োগ জানেন না। তাছাড়া বোয়ালমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ফেজবুক ওয়ালে পোস্টগুলোতে অসংখ্য বাংলা বানান ভুল দেখা যায়। খোদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি এই হাল হয়- তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
Leave a Reply